বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩১ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাজার সন্ত্রাস!

রাজেকুজ্জামান রতন:
বাজার বলতে শুধু কোনো স্থান নয়, বাজার বলতে বোঝায় ব্যবস্থা। অর্থনীতি না বুঝলেও সাধারণ মানুষ এখন এটা হাড়ে হাড়েই বোঝেন। আবার মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে উচ্ছ্বাস, বিতর্ক, আশঙ্কা আর বিরোধিতা চলেছে এবং চলছে। যারা প্রবল সমর্থক পুঁজিবাদের এবং বিশেষত মুক্তবাজারের পক্ষে, তারা বলেছেন এবং বলেই চলেছেন বাজার চলবে বাজারের নিয়মে। সরকারের কিছু করার নেই। সরকার শুধু সহায়তা করবে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। জিনিসের দাম নির্ভর করবে চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে। যদিও চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করার কথা একেবারেই অর্থনীতির গোড়ার বিষয়, কিন্তু বাজারের দিকে তাকালে মনে হয় তার নমুনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

এখানে কত চাহিদা, জোগানের পরিমাণ কত, কে সরবরাহ করবে, বিপণন করবে, কে ভোক্তা কোনো হিসাবই কাজ করে না। সব কিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে বাজার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার কারণে। এই বাজার নিয়ন্ত্রক এখন সিন্ডিকেট। কোন ক্ষেত্রে নেই তারা? কাঁচা মরিচের দাম হাজার টাকা স্পর্শ করল, ভারত থেকে আমদানির ট্রাক আসতে না আসতেই তা নেমে দাঁড়াল ৩০০ টাকায়।

দুদিন পরেই আবার ঊর্ধ্বগামী মরিচের দাম। এর কি ব্যাখ্যা কেউ জানে না? পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও একই ভেলকিবাজি লক্ষ করা গেল। পেঁয়াজের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম নয়, পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হতে না হতেই দাম বেড়ে গেল হু হু করে। আবার সেই আমদানি! ভারত থেকে আমদানির ঘোষণাতেই কমে গেল দাম।

এটা চাহিদা সরবরাহের কোনো তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা যায়? শেষমেশ বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। দেশের মানুষ যা বোঝার তা বুঝে গেলেন। সিন্ডিকেটের প্রবল ক্ষমতার কাছে সাধারণ মানুষের বিপুল অসহায়ত্ব।

কোরবানি ঈদ এলেই প্রতি বছর চামড়া নিয়ে সংকট তৈরি হয়। সরকার এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করেছিল। অথচ পুরনো তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, আজ থেকে ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮৫ থেকে ৯০ টাকা আর খাসির চামড়ার দর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সে বছর রাজধানীতে ছোট আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতিটি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ১ হাজার ৮০০ থেকে আড়াই হাজার এবং বড় আকারের গরুর চামড়া আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এরপর ২০১৪ সালে চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন মিলে চামড়ার দর ২০১৩ সালের তুলনায় কিছুটা কম প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০ থেকে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছিল।

কিন্তু বাজারে তখনো পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় বাস্তবে বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল, সেবার পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়াই বিক্রি হয়েছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকায়।

কিন্তু এরপর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকল। প্রতি বছর চামড়ার দর শুধু কমেছেই। কমতে কমতে ২০১৯ সালে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, অনেকে চামড়া ফেলে দিয়েছিলেন বা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন। এরপরের বছরগুলোয় চামড়া ফেলে দেওয়ার ঘটনা না ঘটলেও এক দশক আগের তুলনায় অনেক কম দরেই বিক্রি হয়েছে।

ফলে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষেরা ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত হলেও লাভবান হয়েছেন আড়তদার, ব্যবসায়ী আর ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু একটা বিষয় তো মাথায় আসতেই চায় না, গত দশ বছরে গরু-ছাগলের দাম বেড়েছে বহুগুণ, মাংসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে কিন্তু চামড়ার দাম গেল কমে! কী ব্যাখ্যা এর? আর কে-ই বা দেবে সে ব্যাখ্যা? আবার চামড়ার দাম কমলেও চামড়ার তৈরি জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য সামগ্রীর দাম কি কমেছে? কমেনি বরং বেড়েছে।

সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা হিসাবে ঢাকায় মাঝারি আকারের ২৫ বর্গফুটের একটি লবণ দেওয়া চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩৭৫ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৭৫ টাকা।

কিন্তু ঈদের দিন যেসব জায়গায় চামড়ার প্রধান বিক্রির পসরা বসে সেখানকার খবর নিয়ে দেখা গেছে পরিস্থিতি ভিন্ন। পুরান ঢাকার পোস্তাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মাঝারি আকারের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে; অর্থাৎ সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে মানুষ সে দামে বিক্রি করতে পারেনি। নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে।

এ তো গেল ঢাকার কথা। ঢাকার বাইরে চামড়ার দর আরও অনেক কম। চট্টগ্রামে এবার বড় গরুর চামড়া ৪৫০ থেকে ৬০০ আর মাঝারি গরুর চামড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর রাজশাহীতে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায়। তবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয়েছে খাসির চামড়ার ক্ষেত্রে, এই চামড়ার ক্রেতা পাওয়াই মুশকিল।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্র পাঁচ টাকা বা তারও কম দামে প্রতি পিস খাসির চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ আমাদের দেশের ব্লাক বেঙ্গল গোটের চামড়া নাকি বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট।

যে ব্যাপারটা লক্ষণীয় তা হলো, সরকার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই গত বছরের তুলনায় এ বছর গরুর চামড়ার দর প্রতি বর্গফুটে মাত্র ৩ টাকা বৃদ্ধি করেছিল, যা শতাংশের হিসাবে মাত্র ৬ শতাংশ আর খাসির চামড়ার কোনো মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি।

সাধারণ হিসেবেই দেখা যায়, চামড়ার মূল্যবৃদ্ধির এই হার সরকার ঘোষিত মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম এবং ডলারের বিপরীতে টাকার যে পরিমাণ অবমূল্যায়ন হয়েছে, তার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।

তাহলে দেখা যায়, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ব্যবসায়ীরা এক বছর আগে যে পরিমাণ ডলার আয় করতেন, তা থেকে টাকা আসত প্রতি ডলারে ৮৬ দশমিক ৪৫ টাকা, বর্তমানে যা ১০৮ দশমিক ৫ টাকা। তাহলে ব্যবসায়ীরা যেখানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আগের চেয়ে ডলারপ্রতি ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি আয় করছেন, সেখানে কাঁচা চামড়ার মূল্য গত বছরের তুলনায় মাত্র ৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল এবং সেটাও মানুষ পায়নি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয় কোরবানির সময়। কোরবানির পশুর দাম নিয়েও চলে নানা কারসাজি। ধরা যাক, একটা মাঝারি আকৃতির গরু যার মাংস হতে পারে ১০ মণ। তার দাম হাঁকা হয় ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। কেন এত দাম চাওয়া হয় বা কেন এত দামে বিক্রি হয়? আবার বাজারে মাংসের দাম কেন ৮০০ টাকা কেজি।

যদি এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বাজার দর অনুযায়ী হিসাব করি তাহলেও তো ১০ মণ মাংস হতে পারে এ রকম গরুর দাম ৪ লাখ টাকার বেশি হওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। আর খামারিদের হিসাবে প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে খরচ ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। তাহলে তো ২ লাখ টাকার বেশি দাম হওয়ার কথা নয়। পশুখাদ্যের সিন্ডিকেট, পথে পথে চাঁদা সব কিছুর প্রভাব পড়ে মাংসের দামের ওপর।

যে কারণে ভারত, পাকিস্তান তো বটেই, যে ইউরোপের উদাহরণ দিতে আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা পছন্দ করেন তাদের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মাংসের দাম অনেক বেশি। আর মাংস উৎপাদনের হিসাব? সেও তো এক গোলমেলে ব্যাপার। মাথাপিছু দৈনিক মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম। তাহলে ১৮ কোটি মানুষের জন্য বছরে মাংসের চাহিদা ৭৮ লাখ টন কিন্তু সরকার বলছে উৎপাদন নাকি ৮৪ লাখ টন।

অর্থাৎ ৬ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু কত শতাংশ মানুষ প্রতিদিন মাংস খেতে পারেন আর তাদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কত এই প্রশ্নের উত্তর কি পাওয়া যাবে? দ্রব্যমূল্য, উৎসব, ত্যাগ আর মানুষের পুষ্টি সবকিছুর ওপরেই তো সিন্ডিকেটের থাবা। মুক্তবাজার অর্থনীতি বহাল রেখে মানুষ কি এই বাজার সন্ত্রাসের কবল থেকে বাঁচতে পারবে?

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

rratan.spb@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION